"ভালোবাসি রোদ জল, আলোর কিরণ,
ভালোবাসি নীলাকাশ নদী-মাঠ-বন।
ভালোবাসি ফুল গান অমল জীবন,
ভালোবাসি আমাদের শিশু অঙ্গন।"
লেখাটি শুরু করার আগে এর চেয়ে ভালো ভূমিকা আর খুঁজে পেলাম না, কারণ একসময় উপরের এই কয়েকটি লাইন দিয়েই আমাদের দিন আরম্ভ হতো, যখন আমরা সবুজ অবুঝ শিশু অঙ্গনের পড়ুয়া ছিলাম। উপরন্তু এই লেখাটি যাঁকে উৎসর্গ করে লিখছি, আমাদের এই বিদ্যালয় ও এই প্রার্থনামন্ত্র ছিল তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের সকলের অত্যন্ত প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় 'স্যার' - অধ্যাপক পুষ্পজিৎ রায়, যিনি মাত্র কয়েকদিন আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও আমরা প্রত্যেকেই জানি, তিনি এবং তাঁর আদর্শ আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় বিরাজমান।
অধ্যাপক পুষ্পজিৎ রায়ের জন্মস্থান যদিও মালদহে নয়, কিন্তু তাঁর কর্মজীবনের প্রায় সমস্ত অংশই মালদহে। তিনি ছিলেন মালদা কলেজের বাংলার অধ্যাপক। তিনি শুধু মালদহের নয়, সেই সঙ্গে বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি পরিমণ্ডলে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। তাঁর যে ক্ষেত্রে অবদান অপরিসীম, তা ছিল বাংলার লোকসংস্কৃতি, বিশেষ করে মালদহের সুপ্রাচীন ও জনপ্রিয় গম্ভীরা গান, যা মটর বাবু ও নীরুবাবু (শ্রদ্ধেয় গম্ভীরা শিল্পী) মারা যাওয়ার পরবর্তী সময়ে ধ্বংস হয়ে যেতে বসেছিল। তাকে আবার পুনরুদ্ধার করেছিলেন যে মানুষটি, তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের শ্রদ্ধেয় পুষ্পজিৎ রায় মহাশয়। যাই হোক, এসব আমার লেখার মূল বিষয় নয়। আজ আমার লেখার মূল বিষয় হলেন আমাদের সকলের প্রিয় 'স্যার' পুষ্পজিৎ রায় এবং তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান 'সবুজ অবুঝ শিশু অঙ্গন '। ১৯৭৫ সালে মালদহ শহরের রামকৃষ্ণপল্লীতে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। অধ্যাপক পুষ্পজিৎ রায়ের পাশাপাশি এই বিদ্যালয়টি স্থাপন ও বিকাশের ক্ষেত্রে যাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য, তিনি হলেন আমাদের 'বড়দিভাই' , সবুজ অবুঝ স্কুলের হেডমিস্ট্রেস স্বপ্না রায়, যিনি ছিলেন পুষ্পজিৎ রায়ের সহধর্মিণী।
আমার ছাত্রজীবনের শুরু যদিও সবুজ অবুঝ শিশু অঙ্গনে নয়, এর আগে অন্য একটি স্কুলে আমি পড়তাম। ১৯৯৭ সালে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে আমি সবুজ অবুঝে নার্সারি এ ক্লাসে ভর্তি হই। তারপরে ২০০৩ সালে চতুর্থ শ্রেণী অবধি ওখানেই পড়াশোনা করি, এবং তারপরে ভর্তি হই রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দিরে। আমার পড়াশোনা, মানসিক বিকাশ, চরিত্র গঠনে এই বিদ্যালয়েরই ভূমিকা অপরিসীম। আজ জীবনে চলতে চলতে পিছন ফিরে তাকালে মনে হয়, ওই সময়টাই আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়।
সবুজ অবুঝে আমরা যখন ভর্তি হই, আমাদের শেখানো হয় হেডমিস্ট্রেসকে 'বড়দিভাই' বলতে ও হেডমাস্টার অর্থাৎ অধ্যাপক পুষ্পজিৎ রায়কে 'স্যার' বলতে। সেই 'স্যার'কে ছোটবেলায় কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমি ভীষণ ভয় পেতাম। পরনে সাদা ধুতি পাঞ্জাবী, হাতে একটি 'walking stick', চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা এবং নাকের নিচে ছোট্ট একটা পেন্সিল গোঁফ নিয়ে তিনি যখন আসতেন, আমি ভয়ের চোটে একটা থামের পেছনে লুকিয়ে পড়তাম।
একদিন উনি আমাদের বাংলা ক্লাস নিতে আসেন। স্বভাবতই খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। কিন্তু উনি ক্লাসে এসে এত সুন্দর সুললিত ভঙ্গিমায় গল্প বলতে শুরু করেন যে আমরা সম্পূর্ণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাই। আমাদের সাথে উনি এমন ভাবে মিশতে শুরু করেন, যেন আমরা ওনারই সমবয়সী। তারপর থেকে ওনার সম্পর্কে যে ভীতিটা ছিল আমাদের, বিশেষ করে আমার, তা সম্পূর্ণ কেটে যায়। এরপর থেকে যখনই ওনার সামনে যেতাম উনি আমার গাল টিপে আদর করে দিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে চকলেট বের করে দিতেন।
শুধু ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনাই নয়, তাদের যেন সর্বাঙ্গীন বিকাশ হয়, সেদিকে ওনার ও বড়দিভাইয়ের ছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। শিশু মনে সর্বদা বাইরের অজানা জগৎ, প্রকৃতি সব কিছু নিয়ে এক কল্পনা কাজ করে। অনেকে সেগুলোকে আজগুবি বলে উড়িয়ে দিলেও আমাদের বিদ্যালয় সেই শিশুদের কল্পনাশক্তিকে সর্বদা উৎসাহিত করে গেছে। এসবই ছিল স্যার ও বড়দিভাইয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত। এছাড়াও স্যার আমাদের গল্প কবিতা এ সমস্ত কিছু লিখতে উৎসাহ দিতেন। অনেক সময় উৎসাহের বশে কিছু বাল্যখিল্য রচনা আমরা লিখেও ফেলতাম। কিন্তু উনি মন দিয়ে পড়ে আমাদের উৎসাহ দিতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উনি নিজেও একজন সুলেখক ছিলেন। "আলোর ফুলকি" বইতে তাঁর একটি কবিতাও ছিলো। আমি একটু গান গাইতে পারতাম বলে উনি আমায় ভালোবাসতেন। আর সরস্বতী পূজার দিন ওনার হাত থেকে পুরস্কার হিসেবে বই পাওয়া ছিলো বাঁধা। সরস্বতী পূজায় হাতের কাজের প্রদর্শনী হতো, যাতে আমরা নিজেদের কল্পনাশক্তির বহিঃপ্রকাশ করতাম। এই সকল কাজে তাঁর উৎসাহ ছিলো অপরিসীম, যা আমাদের মানসিক বিকাশে সহায়তা করেছিল। আজ আমরা যেখানে পৌঁছেছি, সেখানে আমাদের বিদ্যালয় এবং তার দুই কাণ্ডারীর ভূমিকা অপরিসীম। আজ স্যার চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। কিন্তু উনি ওঁনার আদর্শের মধ্য দিয়ে আমাদের হৃদয়ে চিরকাল থাকবেন।
Comments